বৃহস্পতিবার ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম

বৃহস্পতিবার ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

বার্মার শেষ রাজা থিবাউ মিন ও রানী সুপায়ালাত এবং মান্দালয়ের ক্ষমতা-নির্বাসন

বুধবার, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
75 ভিউ
বার্মার শেষ রাজা থিবাউ মিন ও রানী সুপায়ালাত এবং মান্দালয়ের ক্ষমতা-নির্বাসন

কক্সবংলা ডটকম(৬ ফেব্রুয়ারি) :: কোনবাউং রাজবংশের শেষ রাজা থিবাউ মিন। আর রাজতান্ত্রিক বার্মার ইতিহাসে শেষতম রাজবংশ কোনবাউং রাজবংশ। টংগু রাজবংশের পরবর্তী সময়ে মিয়ানমার যখন বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। সে সময়টায়ই ১৭৫২ সালে শোয়েবোর এক গ্রাম্য নেতা আলংপায়া সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেন। মিয়ানমারের দক্ষিণাংশে মন শাসকদের বিরুদ্ধে পরিচালনা করেন সফল সামরিক অভিযান। এভাবে মিয়ানমারকে তিনি একত্র করতে থাকেন। তার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশটি তৃতীয় রাজা হসিনবিয়ুশিনের পর থেকেই প্রতাপশালী রূপ লাভ করে।

১৭৬৪ সালে এ রাজা হসিনবিয়ুশিন রাজ্যে শৃঙ্খলা স্থাপন করেন। তার সেনাবাহিনী শান ও লাও রাজ্য এবং মণিপুর রাজ্যের (বর্তমানে ভারতের একটি প্রদেশ) অনেক গভীরে চলে যেতে সক্ষম হয়। চারবার মিয়ানমারের ওপর চীনা আক্রমণ প্রতিহত করেন তিনি। ষষ্ঠ রাজা বোদওপয়া ১৭৮২-১৮১৯ পর্যন্ত রাজত্ব করেন, তার সময়ে রাজধানী সরিয়ে নেয়া হয় অমরপুরে। বোদওপয়ার পৌত্র বাগিদও (১৮১৯-২৬ খিস্টাব্দ) এর আমলেই প্রথম ইঙ্গ-বর্মি যুদ্ধে (১৮২৪-২৬) মিয়ানমার ব্রিটিশদের হাতে পরাজয় বরণ করে।

এর পর থেকে মিয়ানমারের রাজত্বের পরিধি কমতে থাকে। কমতে থাকে প্রশাসনের ক্ষমতাও। রাজা থারাওয়াদি ও তার পুত্র পাগান দুজনেই ছিলেন শাসক হিসেবে দুর্বল। ফলে ১৮৫২ সালে অর্থাৎ রাজ্য প্রতিষ্ঠার শতবর্ষের মাথায়ই দ্বিতীয় ইঙ্গ-বর্মি যুদ্ধতে ব্রিটিশরা সমগ্র দক্ষিণ মিয়ানমার দখলে নিয়ে নিতে সক্ষম হয়। ১৮৫৩-৭৮ পর্যন্ত রাজা মিনদনের অধীনে মিয়ানমার তার অতীত গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালায়। কিন্তু ততদিনে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেছে। প্রথা অনুযায়ী তখনো রাজবংশের রাজাদের মনে করা হতো গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শাসক। কিন্তু তা কেবল পদবিতেই।

থিবাউকে গ্রেফতার করতে এসেছেন ব্রিটিশ কর্মকর্তা প্রেনডারগাস্ট শিল্পী: মেল্টন প্রায়র। দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ, ৩০ জানুয়ারি, ১৮৮৬

রাজা মিনদন আভা রাজ্য শাসন করতেন মান্দালয়ের গোল্ডেন প্যালেস থেকে। কাঠে নির্মিত অভিজাত সাত স্তরবিশিষ্ট প্রাসাদটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। গোল্ডেন সিটির মধ্যখানে অবস্থিত প্রাসাদটিতে বসবাস করত রাজপরিবারের সদস্যরা। শহরে বসবাস করতেন মন্ত্রী, অভিজাত ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তি। শহরের বাইরে বর্গাকার দেয়াল ও দেয়ালের বাইরে ছিল পরিখা। যে মান্দালয় রাজ্যে মানুষের বসবাস, তা ছিল পরিখার বাইরে।

থিবাউ পড়াশোনা করেছেন মান্দালয়ের মিশনারি স্কুলে। স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রেভারেন্ড ড. জন মার্কসের মাধ্যমে। রাজপরিবারের সদস্যদের স্কুলে আসার দিনগুলো সাধারণত নাটকীয় হয়। তার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ছিল না। একটা হাতির পিঠে ও সাদা ছাতার নিচে তিনি এলেন, সঙ্গে এক দল দেহরক্ষী। ক্লাসে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রছাত্রীরা টেবিল থেকে সরে মাটিতে নেমে শ্রদ্ধায় অবনত হয়। সেই মিশনারি স্কুল থেকেই থিবাউ শিখলেন ইংরেজি। কিছুটা পিয়ানো ও বর্মি ধ্রুপদি সংগীতের দরসও পেয়েছিলেন। মিশনারি স্কুলে দুই বছর থাকার পর থিবাউ চলে গেলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর অধীনে।

এটাও ছিল বর্মি ঐতিহ্যের অংশই। প্রতিটি বর্মি বালককে অল্প সময়ের জন্য হলেও সন্ন্যাসের পাঠ নিয়ে তারপর ফিরে আসতে হতো সাধারণ জীবেনে। থিবাউ রয়েল গোল্ডেন মোনাস্ট্রিতে প্রায় তিন বছর কাটান। পড়াশোনা করেন বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন নিয়ে। পরীক্ষাগুলোয় তার ফলাফল ছিল অত্যন্ত ভালো, তাতে পিতা মিনদন ছিলেন উচ্ছ্বসিত। মিনদন তো ভেবেই বসেছিলেন খুব সম্ভবত থিবাউ হতে যাচ্ছে প্রতিশ্রুত ভবিষ্যৎ বুদ্ধ। তাকে সংবর্ধনা দেয়া হলো। ও তিনি চারটি ছাতা ব্যবহারের অনুমোদন পেলেন। কেবল রাজা ব্যবহার করতে পারতেন আটটি ছাতা।

আভা রাজ্যে সিংহাসনে বসার জন্য কোনো গুরুতর আইন ছিল না। রাজা নিজেই তার ওয়ারিশ নির্বাচন করতেন। যদি রাজা অন্য কোনো সিদ্ধান্ত না নেন, তাহলে প্রথম পুত্রসন্তানই রাজা হতো। যদি বড় সন্তান মারা যেতেন, তাহলে পরবর্তী সময়ে কোনো ধারাবাহিকতা ছিল না। কিং মিনদন উত্তরাধিকার হিসেবে তার ভাই কানাউংকে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু পিতার এ সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়ে দুই সন্তান ১৮৬৬ সালে বিদ্রোহ করে বসে। বিদ্রোহে কানাউং নিহত হন ও বড় ছেলে মালুন মারা যান। এ বিদ্রোহের পর রাজার ৪৮টি সন্তানের মধ্যে অবশিষ্ট ছিল ২২ জন।

ততক্ষণ পর্যন্ত সবার ধারণা ছিল সিংহাসন যাবে তিনজনের যেকোনো একজনের হাতে। বড় রাজপুত্র থোনজ, বীর রাজপুত্র মেকখারা ও ধার্মিক নাইয়ুংইয়ান। সেদিক থেকে কোনো সমীকরণেই থিবাউর রাজা হওয়ার কথা ছিল না। রাজা মিনদন তার ৪১তম সন্তান থিবাউর প্রতি তৃপ্ত ছিলেন। কিন্তু তাকে কখনো সিংহাসনের বসানোর কথা ভাবেননি। বরং মনে করতেন যদি থিবাউ মসনদে বসেন, তাহলে রাজ্য স্বাধীনতা হারাবে।

ঘটনায় নাটকীয় পরিবর্তন আসে ১৮৭৮ সালে। সেবার সেপ্টেম্বরে অসুস্থ ও মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে পড়লে এগিয়ে আসলেন রানী সিনবিয়ুমাশিন। তিনি রাজা ও প্রধানমন্ত্রী কিন উন মিংয়ির মতো অনেককেই বোঝাতে সক্ষম হলেন থিবাউকে রাজা নির্বাচনের কথা। তিনি ভালো করেই জানতেন আগের দফায় ঘটে যাওয়া রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতির কথা।

ফলে থিবাউয়ের জন্য অনুমোদন আনার আগে তিনি নিশ্চিত হয়ে নিলেন, ইতিহাস পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। তিনি তার সব সন্তানকে ডেকে পাঠালেন। তার আহ্বানে ছুটে আসলেন সবাই। কিন্তু বিষয়টি আঁচ করতে পেয়ে নেয়াংগিয়ান ও নেয়ুংগক প্রাসাদ ত্যাগ করলেন। বাকিদের একত্র করে গ্রেফতার করা হলো। ঘটনা কানে যাওয়া মাত্রই নড়েচড়ে বসলেন অসুস্থ রাজা।

তিনি নির্দেশ দিলেন সব ছেলেকে তার সামনে হাজির করতে। সবাই সামনে আসার পর তিনি ঘোষণা করলেন, আভা রাজ্যকে তিনটি পৃথক অঞ্চলে বিভক্ত করা হবে। তিন অংশের প্রধান হবেন থোনজ, মেকখারা ও নেয়াংগিয়ান। বাকিদের বলা হলো তারা তিনটি প্রদেশের যেকোনো একটির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে। এমন নির্দেশনা দিয়েই রাজা দ্রুত তাদের রাজধানী ত্যাগ করতে বলেন। রাজা জানতেন রক্তপাত কেমন হতে পারে।

রাজার কথা মান্য করা হয়নি। মন্ত্রী কিন উন মিংয়ি নিজেই রাজ্যকে তিন টুকরা করতে নারাজ ছিলেন। তার মনে হচ্ছিল এর মধ্যে জন অসন্তোষ তৈরি হবে ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যবসা। ফলে রানী সিনবিয়ুমাশিনের সঙ্গে তিনি পরিকল্পনা করে রাজধানী থেকে দূরে যাওয়া থেকে বিরত রাখলেন। রানী চাচ্ছিলেন থিবাউকেই মসনদে আনতে। মন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি অসুস্থ রাজার সামনে যান।

রাজা তখনো জানেন না সেই তিন ছেলে রাজধানী ত্যাগ করেননি। রানী রাজাকে জানালেন তিন পুত্র যেহেতু অনুপস্থিত, ফলে থিবাউকেই ইংশে-মিন বা সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করা হোক। এভাবে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৮ সালে উত্তরাধিকারী নির্বাচিত হলেন থিবাউ। অসুস্থ রাজার তেমন কিছু করার ছিল না আসলে। ঠিক ওই বছরই ১ অক্টোবর মারা যান তিনি।

রাজার শেষকৃত্য শেষ হয় ৭ অক্টোবর। স্বাভাবিকভাবেই রাজা মিনদনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নতুন রাজা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন থিবাউ। বিদ্রোহ আর রক্তপাতের ভয় ছিল রাজ্যজুড়েই, সে শঙ্কার মধ্যেই। ১১ অক্টোবর নতুন রাজার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলো। মূলত এরপর থেকেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা। নামের সঙ্গে যুক্ত করা হলো অজস্র উপাধি ও বিশেষণ। তিনি যেন জল, স্থল ও উদীয়মান সূর্যের শাসক। তার নাগালে চলে এল রাজকীয় সব পোশাক ও অলংকার। রাজকীয় ছাতা থেকে শুরু করে জুতা পর্যন্ত।

তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১ জানুয়ারি ১৮৫৯ সালে। সেদিক থেকে তার বয়স ২০ বছর হয়নি। থিবাউয়ের অভিষেক অনুষ্ঠিত হয় ১৮৭৯ সালের জুনের প্রথম দিকে। শাসন পরিচালনার দিক থেকে না তার কোনো প্রশিক্ষণ আছে, না কোনো প্রকার অভিজ্ঞতা। প্রতিটি সিদ্ধান্তের জন্যই ছিলেন চারপাশের অভিজ্ঞদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। এজন্যই রানী সিনবিয়ুমাশিন ও তার মন্ত্রীদের জন্যও থিবাউ ছিলেন বেশি গ্রহণযোগ্য। রাজা তো কেবল রাজা নয়, জনগণের ওপরেও তাদের মালিকানা একচ্ছত্র।

কিন্তু সে একচ্ছত্র আধিপত্য এখন নামকাওয়াস্তে। কফিনের শেষ পেরেক বিঁধল থিবাউয়ের সিংহাসনে বসার কিছুদিনের মধ্যেই। সে সময় কিন উন মিংয়ি জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যৌথ পরিষদ গঠন করলেন মন্ত্রিসভার আদলে। বলতে গেলে এক রকম সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকতে চাইলেন তিনি। এর মধ্যে দিয়ে রাজার ক্ষমতা অনেকাংশেই কমে গেল।

১৮৭৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজপরিবারের আট সদস্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাদের মধ্যে রাজকুমার থোনজ ও মেকখারাও ছিলেন। যারা বয়সে খুব ছোট ছিল এবং যারা আগে পালিয়ে গিয়েছিল, কেবল তারাই রেহাই পায় সে হত্যাকাণ্ড থেকে। বোদ্ধামহলে ধারণা, রাজা থিবাউয়ের মা সিনবিয়ুমাশিন এ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। থিবাউ তখন পর্যন্ত মসনদে নতুন। আর তার মা তার মসনদ পোক্ত করার জন্য সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তিনি খুব ভালোভাবেই জানতেন, যদি থিবাউকে সিংহানচ্যুত করা হয়, তার ফলাফল সংশ্লিষ্ট সবার ওপরই পড়বে।

আর দীর্ঘদিন থিবাউকে রাজা বানানোর প্রতিযোগিতাই এর মধ্যে তার অনেক শত্রুও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য রাজা যদিও পরে অস্বীকার করেছেন, না তিনি হত্যাকাণ্ডের কথা জানতেন, আর না তার নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই ব্রিটিশ সরকার ক্রমে নড়েচড়ে বসতে থাকে। থিবাউকে সরিয়ে নিয়াংগিয়ানকে বসানোর চিন্তা করতে থাকে সরকার। নেয়াংগিয়ান তখন পালিয়ে কলকাতায় বসবাস করছিলেন। ক্রমে ব্রিটিশ শক্তির সঙ্গে আভা রাজ্যের সম্পর্ক খারাপ হতে লাগল। এর আগে রাজা মিনদনের সময়ে ফ্রান্সের সঙ্গে বন্ধুত্ব গভীর করে আভা, যা ব্রিটিশ সরকার ভালোভাবে নেয়নি। এছাড়া বার্মার ওপরের অংশকেও অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবতে থাকে। সবিশেষ দুই শক্তির মধ্যে সম্পর্ক নেতিবাচক দিকে বাঁক নেয়া। কয়েক মাসের বিবেচনার পর হুট করেই ১৮৭৯ সালের অক্টোবরে মান্দালয় থেকে সরে যায় ব্রিটিশ বাসিন্দা ও কর্মচারীরা।

এমন পরিস্থিতিতে সতর্ক হয়ে পড়েন রাজা থিবাউ। দ্রুত রেঙ্গুনে দূত পাঠালেও তাতে লাভ হয়নি দিনশেষে। মিশনের ব্যর্থতা ক্রুদ্ধ করে রাজা থিবাউকে। তিনি রীতিমতো ঘোষণা করে দেন, তিনিই বাধ্য করেছেন ব্রিটিশদের মান্দালয় ছাড়তে। শিগগিরই দেশের বাকি অংশ থেকেও তাদের দূর করা হবে। শপথ নিলেন আর কখনো সাদামুখো বিদেশীদের মুখোমুখি হবেন না। এক মজলিসে রানী সুপায়ালাতও গর্বভরে এরই প্রতিধ্বনি করেছেন। এভাবে শাসনক্ষমতায় বসার এক বছরের মধ্যেই সবার কাছে প্রমাণিত হয়ে গেল ক্ষমতার দণ্ড আসলে থিবাউয়ের কাছে নেই।

রানী সুপায়ালাতসূত্র: মিয়ানমার হিস্ট্রিক্যাল আর্কাইভ

বার্মার শেষ রানী সুপায়ালাত

বার্মার শেষ রানী সুপায়ালাত জন্মগ্রহণ করেন ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ডিসেম্বর। ১৯ বছর বয়সে রাজা থিবাউ মিনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এবং সুপায়ালাতই ছিলেন বার্মার মান্দালয় প্রাসাদের শেষ রানী।

আপার বার্মার (দেশটির মধ্য ও উত্তরাঞ্চল) শাসন করা সে সময়ে বেশ কঠিন ছিল। তাই বার্মার রাজা থিবাউসহ কোনবাউং শাসকরা তাদের রাজধানী শাসনের দিকে মনোনিবেশ করেন। স্থানীয় প্রধানদের দায়িত্বে ছিল সমগ্র গ্রামাঞ্চল।

সে সময়ে বর্মি রাজতন্ত্রের ক্ষমতায় ক্ষয় ঘটেছিল মূলত দুটি অ্যাংলো-বার্মি যুদ্ধে (১৮২৪-২৬) এবং (১৮৫২-৫৩) পরাজয়ের ফলে। ক্রমবর্ধমান বিদ্রোহ, দস্যু দলের আক্রমণ ও আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ হওয়ার ফলে উচ্চ বার্মার লোকজন পালিয়ে ব্রিটিশ অধিকৃত নিম্ন বার্মায় চলে যেতে থাকে।

এ অস্থিতিশীল অবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শান জাতিগোষ্ঠি প্রধানদের বিদ্রোহ। অতীতে বর্মি রাজাদের শানপ্রধানদের কন্যাদের ছোট রানী হিসেবে গ্রহণ করার প্রথা ছিল। ফলে শান রাজ্যগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় হতো।

কিন্তু রানী সুপায়ালাত রাজা থিবাউকে আর কোনো স্ত্রী গ্রহণ না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বেড়েই চলেছিল। এ পরিস্থিতিতে অনেকেই মনে করতেন রাজা থিবাউ মান্দালয়ের বাইরে কেবল নামেই শাসন করছেন।

সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থ সংকট দেখা দেয়। এ পরিস্থিতিতে রাজস্ব আহরণ করা বেশ কঠিন কাজ হয়ে পড়েছিল। সমস্যাটি আরো জটিল হয়ে ওঠে, যখন চালসহ বেশকিছু অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী নিম্ন বার্মা থেকে আমদানী করার প্রয়োজন হয়।

নিম্ন বার্মা ১৮২৪ সাল থেকেই ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীনে। ফলে উচ্চ বার্মা শাসন করা রাজা থিবাউর জন্য আরো বেশি কঠিন হয়ে উঠেছিল। এ জটিল পরিস্থিতিকে আরো কঠিন করে তুলেছিল টানা কয়েক বছর ধরে উচ্চ বার্মার অতি বৃষ্টিপাত। ফলে উচ্চ বার্মায় ফলন কমে যায়।

ব্রিটিশ অধীনস্থ নিম্ন বার্মার ইরাবতি দ্বীপ ছিল ফলনের জন্য সুপরিচিত। ফলে আন্তর্জাতিক চাহিদা বৃদ্ধির কারণে চালের দাম বাড়তে থাকে এবং এটি সমগ্র অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি প্রভাব ফেলেছিল। কারণ আদি থেকে বর্মিদের প্রধান খাদ্য ভাত। তারা ভাতকে উন-সা বলে। রাজা থিবাউ রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে শুরু করেন।

রাজকীয় একচেটিয়া ছাড়গুলো বাতিল করা হয়, নতুন কর এবং বিভিন্ন শুল্ক আরোপ করা হয়। ঋণের আশ্রয়ও নেয়া হয়েছিল। এসব উদ্যোগ বৃথা গিয়েছিল দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে। তাই রাজা থিবাউয়ের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার প্রচেষ্টা সফলতা পায়নি।

এসব সমস্যা নিয়ে রাজা থিবাউ ও রানী সুপায়ালাত উদাসীন ছিলেন না। রাজা থিবাউ চেষ্টা করেছেন কীভাবে সাম্রাজ্যকে ব্রিটিশ অধীনতার বাইরে রেখে সচ্ছল করে তোলা যায়। এ প্রসঙ্গে ড. থান্ট মিউন্ট-উ (বর্মি বিশেষজ্ঞ ও গবেষক) মনে করেন, যদিও রাজা থিবাউর শাসনামলকে তার পিতার শাসনামলের তুলনায় দুর্বল বিবেচনা করা হয়। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো পিতার শাসনামলে শুরু হওয়া সংস্কারগুলোকে থিবাউ কেবল জোরদার করেছিলেন।

যদিও খুব দ্রুত সাম্রাজ্যের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হচ্ছিল, তবে এটি সত্য যে রাজা থিবাউ ও রানী সুপায়ালাত—কারোর মধ্যেই তাদের পিতা মিনদনসহ পূর্বপুরুষদের মতো রাজনৈতিক দক্ষতা ও চতুরতা ছিল না। তাদের অনভিজ্ঞতা, অসচ্ছলতা ও সীমিত শিক্ষার কারণে সাম্রাজ্য শাসন জটিল হয়ে পড়েছিল। যৌবনে রাজা থিবাউ ধর্মীয় শিক্ষায় পারদর্শী ছিলেন। ড. মাইকেল ক্যারির মতে, ‘রাজা হিসেবে তার পালি শিক্ষা অধ্যয়নের আগ্রহ ছিল এবং এর বাইরে পাশ্চাত্য শিক্ষা নিয়ে তার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না ।’

এ সময়ে প্রাসাদে বেশ কঠিন সময় পার করছিলেন রাজা থিবাউ ও রানী সুপায়ালাত। কারণ নিয়ন্ত্রণহীন সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে বিভিন্ন প্রথা ও কুসংস্কার তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রাধান্য পেয়েছিল। এগুলো শুরু হয়েছিল বেশকিছু বিস্তৃত ধর্মীয় ও পারিবারিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। যেখানে রাজাকে নেতৃত্ব দিতে হতো।

রাজ্যে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের উৎসবই পালিত হতো। তবে হিন্দু ধর্মের উৎসবগুলোই বেশি জাঁকজমকভাবে পালিত হতো। বৌদ্ধ ধর্মের কোনো আচার-অনুষ্ঠান তেমন পালন করা হতো না। কারণ বৌদ্ধ ধর্ম পালনকারীরা উৎসব এড়িয়ে চলতেন তাদের ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখতে। তবে বর্মি রাজদরবার বৈদিক নানা অনুষ্ঠানকে নিজেদের সুবিধামতো সংস্কার করে নিয়েছিল।

বর্মি অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল থিয়াং ও থায়িংয়ুথ উৎসব। থিয়াং বা পানি উৎসব পালিত হতো এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে এবং এটি বার্মিজদের নববর্ষ পালনে উদযাপিত হতো। থায়িংয়ুথ বা আলোর উৎসব পালিত হতো অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে। এটি ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি পবিত্র উৎসব। এ উভয় অনুষ্ঠানের জন্য জুন-জুলাইয়ে কাউদাও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল এবং রাজা থিবাউ রানী সুপায়ালাতকে নিয়ে জমকালো পোশাকে উপস্থিত থাকতেন। সেখানে ভক্ত জনতা ভিড় করত তাদের দেখতে। বৃহৎ রাজপরিবারের প্রাত্যহিক জীবন, জন্ম, বিবাহ ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যেকোনো কিছুতেই অনুষ্ঠান সর্বদা পালন করা হতো।

রানী সুপায়ালাতের ওপর কোথাও একটি দায়বদ্ধতা ছিল সন্তান জন্ম দান নিয়ে। বিশেষ করে পুত্রসন্তান জন্ম দিতে হবে তাকে, যেন রাজা থিবাউ পুনরায় বিয়ে করতে না পারেন। রাজপ্রাসাদের ক্ষমতার লড়াই এবং রাজনীতি সবই ছিল রেষারেষিতে পূর্ণ। রাজ্যে যে মন্ত্রীরাই শাসন করতেন তাদের অধিকাংশই ব্যক্তিগত লাভের চিন্তায় বিভোর থাকতেন। রাজা ও রানী উভয়ই এসব বিষয় নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতেন, অনেকেই মনে করতেন তাদের ব্যক্তিগত জীবন বলতে হয়তো কিছু নেই।

মন্ত্রিসভার সামান্যতম অপরাধের জন্য তাদের যেকোনো একজনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতেন। কিন উন মিংয়ি যখন রাজা থিবাউর ক্ষমতায় হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছিল, তখন তার দুই হাত কেটে ফেলা হয়েছিল। প্রাসাদের সব আচার-অনুষ্ঠান, বিনোদন, রাজনীতিতে কড়াকড়ি আনা হলেও রাজা বর্মি নিজেই এসবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এবং রাজার সম্পৃক্ততা মানেই ছিল রানী সুপায়ালাতের সম্পৃক্ততা।

বিদেশীদের নিয়ে রানীর তেমন কোনো কৌতূহল ছিল না। প্রাসাদ থেকে বাইরের জগতের সঙ্গে রানীর যোগাযোগ ছিল মান্দালয়ে বসবাসরত বহু বিদেশী ইউরোপীয়, ইউরেশীয়, আর্মেনীয়দের। এদের মধ্যে বেশকিছু কালামা অর্থাৎ বিদেশী নারী ছিলেন, যারা রানীর দাসী এবং রাজদরবারে ছোট বড় পদে কাজ করতেন। তবে এরা সবাই রাজনৈতিক ভাবনায় অজ্ঞ ছিলেন এবং তাদেরও ব্যক্তিগত স্বার্থ ছিল মন্ত্রীদের মতোই।

তাই তাদের থেকে কোনো তথ্য সংগ্রহ কিংবা পরামর্শ গ্রহণ করাকে সঠিক মনে করতেন না রানী। তবে কিছু সময় তাদের দামি উপহারের বিনিময়ে নানা তথ্য জিজ্ঞাসা করতেন। বিদেশীদের ও বিদেশী কোম্পানিসহ ব্রিটিশদের বাণিজ্য রুট ইত্যাদি তথ্য তিনি এ কালামাদের মাধ্যমে জানতেন। মান্দালয়ে তখন এ কালামাদের প্রভাব ছিল অনেক বেশি। বিশেষ করে ১৮৭৯ সালে ব্রিটিশদের চলে যাওয়ার পর।

এর পরের বছরই ১৮৮০ সালে রানীর ছয় মাস বয়সী পুত্রের আকস্মিক মৃত্যু ঘটে বসন্ত রোগে। এ সময়ে রানী সুপায়ালাত দ্বিতীয়বারের মতো গর্ভবতী ছিলেন এবং তিনি প্রার্থনা করছিলেন যেন তার পুত্রসন্তান হয়। পুত্রসন্তাদের আশায় পুরো রাজ্যে প্রস্তুতিতে কোনো কমতি ছিল না। স্বর্ণের তৈরি খাট থেকে শুরু করে সবকিছুতেই ছিল স্বর্ণের ছোয়া।

১৮৮০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর রানী সুপায়ালাত কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। তবে কন্যাসন্তানকেও একইভাবে বরণ করা হয়েছিল। নানা উৎসব উদযাপনের মধ্য দিয়ে পালন করা হয়েছে কন্যাকে নিয়ে প্রতিটি অনুষ্ঠান। এ কন্যাশিশুকে ‘সিনিয়র মিস্ট্রেস অব দ্য হেড গ্রুপ অব গডেসেস’ উপাধি দেয়া হয়েছিল। যেহেতু তার শরীরে শুদ্ধ কোনবাউং বংশের রক্ত ছিল এবং পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান, তাই তিনি পরবর্তী রানী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।

তবে এতকিছুর পরও কন্যাসন্তানের জন্ম রানী সুপায়ালাতের জন্য সুখকর ছিল না। তিনি পুত্রসন্তান আশা করেছিলেন কারণ না হলে থিবাউয়ের একাধিক স্ত্রী গ্রহণের সুযোগ তৈরি হতে পারে। এ ভাবনায় রানী উদ্বিগ্ন ছিলেন। সর্বোপরি তার আগের কোনবাউং রাজারা তাই করেছিলেন।

পুত্রসন্তানের মৃত্যু, এরপর কন্যাসন্তাদের জন্ম, রাজ্যের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এসব কিছুর প্রভাবে রাজা থিবাউর সঙ্গে তার সম্পর্কের বা রাজপ্রাসাদের ওপর তার প্রভাব কমে যায়। বন্ধু ইয়ানাউং রাজা থিবাউকে সাম্রাজ্যের এ পরিস্থিতিতে উত্তরাধিকারী বা পুত্রসন্তানের জন্য পুনরায় বিয়ে করতে নির্দেশ দেন। অতঃপর ১৯ বছর বয়সী মি খিংগিকে রাজা বিয়ে করলেন। তবে রানী সুপায়ালাতের ভয়ে স্ত্রী মি খিংগিকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল দীর্ঘদিন।

যখন ১৮৮১ সালে রানী সুপায়ালাত আবারো কন্যাসন্তান জন্ম দিয়েছিলেন, তখন থেকেই রাজা থিবাউ মি খিংগির সঙ্গে থাকা শুরু করেন। শুরু হলো রাজা থিবাউ ও রানী সুপায়ালাতের মধ্যে পারিবারিক কলহ। তবে এক পর্যায়ে এসে রানী উপলদ্ধি করেন তিনি রাজা থিবাউকে অসম্ভব ভালোবাসেন এবং মি খিংগিকে যেভাবেই হোক রাজার জীবন থেকে সরাতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন রাজার একমাত্র বন্ধু ইয়ানাউংকে সরিয়ে ফেলা। কারণ থিবাউ যদি কারো কথাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন সে হলো বন্ধু ইয়ানাউং।

এর মধ্যেই ১৮৮২ সালের প্রথমে রাজা থিবাউ রাজ্যের চারপাশে অভিযোগ বাক্স স্থাপন করেন। রানী সুপায়ালাত নিশ্চিত ছিলেন এ বাক্সগুলো পূর্ণ হবে ইয়ানাউংকে ঘিরে অভিযোগে। তবে বানোয়াট অভিযোগ নয়। বরং সব অভিযোগই ছিল সত্য। ইয়ানাউং ছিল একজন অসৎ ব্যক্তি এবং তার বিরুদ্ধে রাজ্যের অর্থনীতি ধ্বংস ও জনগণকে নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল। আরো একটি পিটিশন হয়েছিল, যেখানে ৩৬ জন স্বাক্ষর করেছিলেন—রাজা থিবাউকে অপসারণের ষড়যন্ত্রে ইয়ানাউং এ কাজ করেছিলেন। থিবাউ বুঝতে পেরেছিলেন এ কঠিন পরিস্থিতেতে তার নির্ভরযোগ্য একজনই আছেন, তিনি হলেন রানী সুপায়ালাত। রাজা তার রানীর কাছে ফিরে গেলেন।

তল্লাশি চালানো হলো ইয়ানাউংয়ের পুরো বাড়ি। ইয়ানাউংয়ের বাড়ি পৌঁছে রানী সুপায়ালাত জানতে চাইলেন, কেন রানীর চেয়ে তার বেশি সম্পদ আছে। এ কথা বলার পেছনে কারণ ইয়ানাউংয়ের বাড়ি স্বর্ণ-রুপা দিয়ে পূর্ণ ছিল। ইয়ানাউং যে রাজা থিবাউর বিরুদ্ধাচরণ করছিল তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া যায় শোয়ার ঘরে গিয়ে। ইয়ানাউং রাজার মতো করেই স্বর্ণখচিত নকশা করে তার খাট তৈরি করেছিল। রানীর নির্দেশে ইয়ানাউংয়ের সব সম্পদ জব্দ করা হয় এবং তাকে বন্দি করা হয়েছিল। তবে থিবাউর এত কাছের বন্ধু হওয়ার ফলে তার মৃত্যুদণ্ড সহজেই অনুমোদন করতে কষ্ট হচ্ছিল।

রানী সুপায়ালাতের নির্দেশে শিও লান বো ইয়ানাউংকে জেলে নিয়ে যায়। এবং তিনি একটি জোড়া লম্বা কাঁচি দিয়ে ইয়ানাউংকে হত্যা করেন। এবং হত্যার পর ইয়ানাউংয়ের হাতে কাঁচি রেখে দেন আত্মহত্যা বোঝাতে। এ গল্প বার্মায় এখনো এতটাই বিখ্যাত যে মান্দালয়ে এ কাঁচি ইয়ানাউং কাঁচি নামেই পরিচিত।’

রানী সুপায়ালাতের মাধ্যমে রাজা জানতে পারেন তার বন্ধুর এ পরিণতির কথা। তবে এ পরিস্থিতিতে তার মনে ইয়ানাউংকে নিয়ে আর কোনো ক্ষোভ ছিল না। এর পরেই রানী মি খিংগিকে রাজপ্রাসাদ থেকে অপসারণ করা হয়। পরোক্ষণেই মি খিংগিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় রানী সুপায়ালাতের নির্দেশে। এ সময়ে মি খিংগি গর্ভবতী ছিলেন। যদিও বিষয়টি রাজা থিবাউ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

রানী সুপায়ালাত এসব কিছুর শেষে চেয়েছিলেন তার সাম্রাজ্যে একটি স্থিতিশীল শাসন ব্যবস্থা স্থাপন হোক। রাজ্যের সব অনিয়ম তিনি কঠোর হস্তে দমন করতে চেয়েছেন। ১৮৮২ ও ৮৩ সালের মধ্যে রানী আরো দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। তবে দুর্ভাগ্যবশত দুজনই মারা যান। প্রায় ছয় বছরের কাছাকাছি সময়ে রানী পাঁচজন সন্তান জন্ম দিয়েছেন। যার মধ্যে কেবল একজন ছিল পুত্র সন্তান এবং দুজন কন্যা সন্তান বেঁচে ছিল। রানী সুপায়ালাত দুই কন্যার মৃত্যুশোক কাটিয়ে ওঠার আগেই নিজের পরিবার থেকে আবার আঘাত পেয়েছেন। তার মা সিনবিয়ুমাশিন যিনি তার কনিষ্ঠ কন্যা সুপায়াগির সঙ্গে মিংগুনের রাজপুত্রের বিবাহ দেন।

মান্দালয় প্রাসাদে দেখা দেয় নতুন ষড়যন্ত্র, সিংহাসন দখল নিয়ে। রাজা মিনদনের একটি মাত্র ছেলে বেঁচে ছিল তার সঙ্গেই বিয়ে হয়েছিল সুপায়াগির। থিবাউকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। রানী সুপায়ালাত বুঝতে পেরেছিলেন রাজ্য নিয়ন্ত্রণ ও মা সিনবিয়ুমাশিনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে তাকেই এগিয়ে যেতে হবে। রানী সুপায়ালাত ভেবেছেন যদি তার ছোট বোনের সঙ্গে রাজা থিবাউর বিয়ে দিতে পারেন, তবে উত্তরাধিকারী দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে। রানী যখন বোন সুপায়াগিকে প্রস্তাব দেন বিনয়ের সঙ্গে সুপায়াগি তা ফিরিয়ে দিয়েছিল।

তবে সুপায়াগি ছিল অত্যন্ত ভিরু প্রকৃতির মেয়ে। সে জানত তার বোন সুপায়ালাত কতটা কঠোর নিজের সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা নিয়ে। পরিশেষে তাই হয়েছিল সুপায়াগিকে তার বোনের কথা মেনে নিয়ে রাজা থিবাউকে বিয়ে করতে হয়েছিল। সব আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়েই বিয়ে হয়েছিল। রানী সুপায়ালাত নিজের ছোট বোনকে রাজার নিকট হাজির করেছিলেন ছোট স্ত্রী বা রানী হিসেবে। দুর্ভাগ্যবশত, এ এরপর থেকে সুপায়াগি কখনই বড় বোন সুপায়ালাতকে তার যোগ্য সম্মান বা সদাচরণ করেননি। বরং জনসম্মুখে রানীকে অপমান করতেন পরিষ্কারভাবে তাকে বোঝানোর জন্য এখন ক্ষমতা কোথায় রয়েছে।

রানী সুপায়ালাত পুরো জীবন চেষ্টা চালিয়েছেন রাজা থিবাউ যেন কখনো পুনরায় বিয়ে না করেন। তবে সর্বশেষ তিনি নিজেই থিবাউকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েছেন কেবল মান্দালয়ে ক্ষমতা যেন রক্ষা পায়।

মান্দালয় প্রাসাদ ছবি: স্টিফেন জে ম্যাসন

মান্দালয় প্রাসাদই ছিল তাদের জমকালো পৃথিবী

দুর্বল শাসকদের মধ্যে থাকে উৎখাত ও গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার ভয়। সে ভয় থেকেই থিবাউ নিজেকে অন্তরীণ করেছিলেন প্রাসাদে। বার্মার শেষ রাজা থিবাউ ও রানী সুপায়ালাত তাদের প্রাসাদ থেকে বের হতেন না। কিন্তু মানুষ আর কত বন্দি থাকতে পারে! মানুষ বাইরের দিকে তাকাতে চায়। সে কারণে সোনালি প্রাসাদে থিবাউ তৈরি করেছিলেন একটি ওয়াচ টাওয়ার। এর উচ্চতা ছিল ৭৯ ফুট। মাঝে মাঝেই রাজা ও রানী সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতেন ওয়াচ টাওয়ারের শীর্ষে। সেখান থেকে দেখতেন তাদের রাজ্য। এছাড়া ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা যেত মান্দালয় ও ইরাবতি নদীর প্যানোরমিক দৃশ্য। এমনকি আকাশ পরিষ্কার থাকলে শান পর্বতও দেখা যেত। মান্দালয় পর্বত ছিল প্রাসাদের উত্তর-পূর্বে।

মান্দালয় ও এর পরিপার্শ্ব নিয়ে একটি মিথ আছে। বলা হয় ভগবান বুদ্ধ এককালে মান্দালয়ে এসেছিলেন এবং তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মান্দালয়ের দক্ষিণে একটি শহর গড়ে উঠবে। তিনি আরো বলেছিলেন এ শহর বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্র হিসেবে প্রকাশিত হবে। সে কথার কারণেই বার্মার রাজা মিনদন অমরপুর থেকে রাজধানী সরিয়ে নেন এবং কথিত স্থানে স্থানান্তর করেন। সেখানে তৈরি হয় প্রাসাদ। বলা বাহুল্য মিনদন ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ বৌদ্ধ। ১৮৫৭ সালের একটি দিনকে শুভ বিবেচনায় উৎসব করে জনসাধারণকে অমরপুর থেকে নিয়ে আসা হয়। মান্দালয়ের নাম দেয়া হয়েছিল রত্নপুর অর্থাৎ রত্নরাজির শহর। এটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় দুই বছর এবং ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মে এর কাজ শেষ হয়। শহরের বাইরে কাঠের একটি স্তম্ভে লেখা হয়েছিল শহর সম্পর্কে।

এ শহর ও প্রাসাদ নিয়েও আছে মিথ। বলা হয় শহর ও প্রাসাদের সদর দরজার নিচে বহু মানুষকে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়েছে। এদের আত্মা ওই দরজার পাশে ঘোরাফেরা করে এবং তারা জানে কোন ব্যক্তি অসাধু উদ্দেশ্য নিয়ে ঘুরছে এবং সেসব ব্যক্তিকেই আক্রমণ করে। এরা শহরের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত। তবে কেবল আত্মা দিয়েই তুষ্ট ছিলেন না রাজা। আয়তাকার এ শহর ও প্রাসাদের সুরক্ষার জন্য তৈরি করেছিলেন পরিখা ও চারটি সুদৃঢ় দরজা। শহরের মূল প্রবেশদ্বার ছিল পূর্ব দরজা। আর দক্ষিণ দরজা দিয়ে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হতো বলে নামকরণ করা হয় ‘সৎকারের দরজা’।

রাজকীয় সোনালি শহরের সোনালি প্রাসাদটি ছিল শহরের একদম মাঝখানে। এর চারপাশে ছিল গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ১২ ফুট উঁচু বেড়া। বেড়ার ভেতরে ৬০ ফুট চওড়া লন তৈরি করা হয়েছিল। লনের পর আবার ইটের তৈরি দেয়াল। অর্থাৎ মূল প্রাসাদকে আলাদা করা হয়েছিল সবকিছু থেকে। সোনালি প্রাসাদেরও ছিল চারটি প্রবেশদ্বার। তাদের ছিল আলাদা আলাদা রঙ। প্রাসাদে লাল রঙের পূর্ব দরজা ছিল রাজার বিশেষ ও প্রধান প্রবেশদ্বার।

প্রাসাদটি এমনভাবে তৈরি হয়েছিল যে শহর থেকে তাকে সহজেই আলাদা করা যায়। শহরের সাধারণ এলাকার তুলনায় প্রাসাদ তৈরি করা হয়েছিল উঁচু ভিতের ওপর। এছাড়া ছিল ভিন্ন গঠনশৈলী। সাধারণ বাড়িগুলো ছিল বাঁশের তৈরি এবং এর ওপর খড়ের ছাউনি। রুডইয়ার্ড কিপলিং তার মান্দালয় কবিতার শহরটির রোমান্টিক বর্ণনা দিলেও এ শহর ততটা রোমান্টিক ছিল না। পুলিশ সার্ভিসের সুবাদে ১৯২০ সালে বার্মায় পোস্টেড ছিলেন জর্জ অরওয়েল। তিনি বলেছেন, মান্দালয় ছিল পাঁচটি ‘পি’র জন্য বিখ্যাত—প্যাগোডা, পারিয়া, পিগ (শূকর), প্রিস্ট (পুরোহিত) ও প্রস্টিটিউট (দেহোপজীবিনী)।

তবে সে তুলনায় খুবই রোমান্টিক ছিল এর রাজার মূল প্রাসাদ। অনেকটাই গোবরে পদ্মফুলের মতো। প্রাসাদের মূল কাঠামো তৈরি হয়েছিল ভূমি থেকে ৭ ফুট উঁচুতে। ভিত ছিল আয়তাকার। প্রাসাদের পূর্ব প্লাটফর্মের ওপর সাতটি সোপান রাখা হয়েছিল এবং তা সাজানো হয়েছিল নানা ধরনের রত্ন দিয়ে। এর ওপরে ছিল ছাতার মতো একটি অবকাঠামো। তাতে যুক্ত করা হয়েছিল ছোট ছোট ঘণ্টা যেন বাতাস এলেই এক ধরনের মিষ্টি আওয়াজ তৈরি হয়।

বার্মার রাজার সিংহাসন ছিল সত্যিকারের সিংহ চিহ্নিত আসন। এতে ছিল নানা চিত্র ও চিহ্ন। এর মধ্যে ছিল ময়ূর কেননা এটি বার্মার রাজবংশের পরিচয় বহন করে। ময়ূর দিয়ে সূর্যকে বোঝানো হতো। বার্মার রাজারা নিজেদের মনে করত ভারতের সূর্যবংশের অনুসারী। আর সিংহটি ব্যবহার করা হয়েছিল সাহসের প্রতীক হিসেবে। সিংহাসনের ওপরের দিকে খোদাই করা হয়েছিল ৩৩ দেবতার চিহ্ন। মূলত তারা বৌদ্ধ ধর্মের ত্রয়োত্রিংশ স্বর্গের দেবতা। রাজাদের বিশ্বাস ছিল স্বর্গ থেকে দেবতারা রক্ষা করবেন এ সিংহাসন। বলা বাহুল্য, সিংহাসনে কেবল রাজাই বসতে পারতেন। তার প্রধান রানীর বসার অনুমতি ছিল রাজার ডান দিকে।

সিংহাসনের সামনেই ছিল আয়তাকার বৃহৎ সভা। এখানেই সাধারণ মানুষ ও রাজার পারিষদরা আসতেন। এর বিপরীতে ছিল পদ্ম সিংহাসন কক্ষ। সে কক্ষে মূলত রানী বসতেন তার কাছে আসা অতিথি ও নিজের বয়সীদের নিয়ে। প্রাসাদের পশ্চিম অংশ মূলত নির্ধারিত ছিল নারীদের জন্য। সেখানে প্রধান রানী, রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ নারীদের পাশাপাশি তাদের প্রধান দাসী ও পরিচারকরা থাকতেন।

প্রাসাদের পূর্ব অংশে ছিল বড় সভাকক্ষটি। সেখানে সিংহ সিংহাসনের পাশাপাশি ছিল আরো ছয়টি সিংহাসন। প্রতিটি সিংহাসনের সঙ্গে ছিল আলাদা করে একটি সিংহাসন কক্ষ। এছাড়া এ অংশেই ছিল রাজার প্রধান কোষাগার। লেখার শুরুতেই যে ওয়াচ টাওয়ারটির কথা বলা হয়েছে সেটি তৈরি হয়েছিল মূল সিংহাসন তথা সিংহ সিংহাসন কক্ষ বরাবর। এছাড়া ছিল ঝরনা দিয়ে তৈরি একটি অংশ। ইতালিয়ান একজন শিল্পীকে দিয়ে কক্ষটির দেয়ালে নানা চিত্রকর্ম আঁকানো হয়েছিল। রাজা ও রানী গ্রীষ্মকালে কক্ষটিতে সময় যাপন করতেন।

শিশমহল বাংলা ভাষায় খুবই পরিচিত। অনেক ক্ষেত্রে একে আয়নামহলও বলা হয়। মূলত কাচ ও আয়না দিয়ে তৈরি হয় এ মহল। বার্মার রাজার প্রাসাদে তা থাকবে না এমন তো হয় না। এ মহলের ভেতরের অংশ আয়না দিয়ে সাজানো এবং সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে নান রঙের কাচ। এটি ছিল প্রসাদের অন্যতম সেরা, সুদৃশ্য অংশ। এছাড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাচ দিয়ে শিশমহলে তৈরি করা হয়েছিল মোজাইক। পুরো প্রাসাদেই মোম জ্বালানো হতো। তবে শিশমহলের জন্য বিশেষ ধরনের মোম ব্যবহার করাই ছিল প্রাসাদের রীতি।

প্রাসাদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ছিল সুসজ্জিত বাগান। এতে নানা জাত, বর্ণ ও গন্ধের ফুলের গাছ ছিল। এছাড়া ছায়া দেয় এমন আকৃতির গাছও লাগানো হয়েছিল। রানী সুপালায়াত মাঝে মাঝেই বাগানগুলোয় চড়ুইভাতির পাশাপাশি সখীদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতেন। ফিল্ডিং ও হল তাদের থিবাউ’স কুইন বইয়ে এক পরিচারিকার স্মৃতিচারণ যুক্ত করেছেন। পরিচারিকা বলেন, ‘আমি স্মরণ করতে পারি বাঁশঝাড়ের পেছনে একটি টিলায় তিনি হাঁটু গেড়ে বসে আছেন। সবাই তাকে দেখতে পারে সহজেই। আমি তাকে একবার খুঁজে বের করি আর তিনি আমার কানে মুষ্ট্যাঘাত করেন। তাকে খুঁজে বের করার অনুমতি আসলে কারো ছিল না। শুধু রাজা যখন আমাদের সঙ্গে খেলতেন, তিনি পারতেন। আমরা যখন তাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যেতাম, তিনি হাসতে হাসতে বেরিয়ে এসে নিজেকে খুব চতুর দাবি করতেন।’

রাজাদের জীবন রাজকীয়ই হতো তা সে রাজা ছোট হন বা বড়। বার্মার শেষ রাজা থিবাউ কেবল একটি প্রাসাদের মধ্যে বাস করেও যাপন করেছেন আয়েসি জীবন। রানী সুপায়ালাতের লুকোচুরি খেলা তার একটি অংশ মাত্র। বলা হয় বার্মিজদের মতো থিয়েট্রিক্যাল পারফরম্যান্স পৃথিবীতে আর কেউ দেখেনি। রাজা থিবাউ ও রানী সুপায়ালাত কখনো প্রাসাদের বাইরে পা রাখেননি। তাই প্রতি সন্ধ্যায়ই তারা প্রাসাদে কোনো না কোনো আসর বসাতেন। কখনো রাজার প্রিয় নর্তকী একাই নাচত। এ নর্তকীর রূপ ও নাচের গুণ সারা বার্মা জানত। বলা হয় একটা নরম ঘাস যেমন বাতাসে নড়ে, প্রধান নর্তকী সেভাবেই নাচতে পারতেন।

কেবল মানুষের উদ্দাম বা শৈল্পিক নৃত্যই না, কখনো কখনো আয়োজিত হতো পুতুলনাচ। বার্মার বিখ্যাত পুতুলনাচের শিল্পী মাং থা বো এজন্য রাজার প্রিয় ছিলেন। রাজা যেহেতু বৌদ্ধ ছিলেন, তিনি জাতকের গল্প পছন্দ করতেন। কিন্তু সে গল্প কেবল শুনে নয় তিনি দেখেও আনন্দ নিতেন। জাতক কথা অভিনয়ের জন্য ছিল আলাদা দল। তারা বিচিত্র পোশাক নকশা করে সেসব পরে রাজার সামনে জাতকের নানা গল্প অভিনয় করে দেখাত। আর সেসবে যখন রাজা আগ্রহ হারাতেন, তখন অভিনয় হতো দেশ বিদেশের নানা নায়কের বীরত্বের গল্প। এ অভিনয় দেখারও ছিল বিলাসী রীতি। রাজা ও  রানী তক্তপোশের ওপর কুশনে হেলান দিয়ে বসতেন। সেবার জন্য হাজির থাকত বহু পরিচারিকা। আর রাজা রানীর পাশে থাকত সোনার পানদান। একজন পরিচারিকা থাকতেন কেবল চুরুট নিয়ে।

ধূমপান সেকালে খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল। আর রাজপরিবার তো ইচ্ছামতো করত। এর মধ্যে রানী সুপায়ালাতের ধূমপান বিখ্যাত। কথিত আছে, রানী সুপায়ালাতের ছিল ৩০০ পরিচারক। তিনি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন এবং তার পরিচারকরা প্রথমেই তাকে এক কাপ চা দিয়ে ঘুম ভাঙাত। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হতো স্নানাগারে। সেখানে তিনি সময় নিয়ে স্নান সারার পাশাপাশি শুনতেন নানা গল্প। প্রতিদিন তিনি বিচিত্র নকশার পোশাকে নিজেকে সাজাতেন। সাজগোজের প্রতি তার ছিল বিশেষ ঝোঁক। এজন্য পরিচারকরাও তাকে নানা সাহায্য করত। তার পরিচারিকাদের ৫০ পাউন্ড করে পারিশ্রমিক দেয়া হতো প্রতি মাসে। কিন্তু প্রাসাদের ভেতরে তাদের অবশ্যই নগ্নপদে থাকতে হতো। এটিই ছিল রীতি। অবশ্য প্রত্যেক পরিচারকের থাকত নিজস্ব কামরা।

পরিচারকদের সঙ্গে সুপায়ালাতের সম্পর্ক নিয়ে তার নাতনির স্মৃতিচারণ উল্লেখ করার মতো। তিনি বলেন, ‘তিনি (সুপায়ালাত) যদি কাউকে পছন্দ করতেন তাকে দামি উপহার দেয়া হতো। এর মধ্যে থাকত দামি রেশম, সাটিন ও মখমলের কাপড়। এছাড়া নানা সময় তিনি বড় বাক্সে করে রত্নরাজি নিয়ে আসতেন। এর মধ্যে দামি রত্ন ও স্বর্ণ থাকত। পরিচারিকাদের তিনি দান করতেন অকাতরে। তারা প্রত্যেকে দুহাত ভরে যা নিতে পারতেন তা-ই নিতে পারতেন।’

প্রাসাদে থিবাউর চেয়ে সুপায়ালাতের জোর ক্ষেত্রবিশেষে বেশি খাটত। তবে রাজা থাকতেন নিজের কাজে। এর মধ্যে থিবাউ ও সুপায়ালাত প্রতি সকালে ও সন্ধ্যায় প্যাগোডায় প্রার্থনা করতে যেতেন একসঙ্গে। প্রাসাদ থেকে তারা বের হবেন না তা নিজেরাই নিশ্চিত করেছিলেন। তাই বছরে উৎসবে ও কয়েকটি সময়ে রাজা থিবাউ তার প্রাসাদের বারান্দা থেকেই জনতার উদ্দেশে ছুড়ে দিতেন অর্থ। প্রাসাদে বসেই হতো সব সিদ্ধান্ত। নানা আলাপ আলোচনা। বিশেষত ভিক্ষু ও সন্ন্যাসীদের সঙ্গে। থিবাউ ও সুপায়ালাতের পৃথিবীই ছিল এ প্রাসাদ। এটিকেই তারা করেছিলেন ক্ষমতা ও রাজ্যের কেন্দ্র।

রত্নগিরিতে বর্মি রাজার নির্বাসন

রাজা থিবাউকে নিতে এসেছে ব্রিটিশ সেনা শিল্পী: সায়া শোন

রাজা থিবাউ মিন বার্মার উপকূল ত্যাগ করার দিনই মান্দালয়ের রাজপ্রাসাদে রাজকীয় সাদা হাতিটি মারা যায়। এটি ছিল অশনিসংকেত। রাজপরিবারের জন্য। বার্মার অধিবাসীদের জন্যও বটে। হাতিটি মারা যাওয়ার এক মাসের মধ্যেই বার্মা তার স্বাধীনতা হারিয়েছিল। ১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি লর্ড ডাফরিন বার্মাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেন।

জাহাজের নাম থুরিয়া। স্কটিশ মালিকানাভুক্ত ‘ইরাবতী ফ্লোটিলা কোম্পানি’র একটি স্টিমার। ১৮৮৫ সালের ২ ডিসেম্বর এটি বার্মার মান্দালয় শহর থেকে যাত্রা করে। আরোহী রাজা থিবাউ মিন ও তার পরিবার। প্রাথমিকভাবে সহযাত্রী ছিল ৮০ জন। তারা ভেবেছিল যে রাজাকে ইয়াঙ্গুনে নির্বাসন দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ভারতে পাঠানো হচ্ছে জানতে পেরে অধিকাংশই মান্দালয়ে ফিরে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৭ জন পরিচারিকা, দুজন অমাত্য ও একজন দোভাষী রাজপরিবারের সঙ্গে ভারতে গিয়েছিল। থুরিয়ায় দায়িত্বরত কর্মকর্তারা রাজপরিবারের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছিলেন।

ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল লর্ড ডাফরিন এ মর্মে কর্মকর্তাদের কাছে স্মারকলিপি পাঠিয়েছিলেন। ছয়দিন পর জাহাজটি রেঙ্গুনে পৌঁছায়। সেখান থেকে মাদ্রাজগামী একটি স্টিমারে রাজপরিবারকে তোলা হয়। মাদ্রাজে সাময়িক অবস্থানের পর রাজপরিবারকে আরেকটি জাহাজে তোলা হয়েছিল। জাহাজের নাম ছিল ক্লাইভ। যাত্রার ধারাবাহিকতায় রত্নগিরি বন্দরে থামে সে জাহাজ। ততদিনে থিবাউ মিনের জানা হয়েছে যে এ নির্বাসনের মেয়াদ আমৃত্যু। বার্মা মুলুকে কখনো ফেরা হবে না আর!

তৃতীয় অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধের সূত্র ধরে রাজা থিবাউ মিনকে রত্নগিরিতে নির্বাসন দিয়েছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। ১৮৮৫ সালের নভেম্বরে এ যুদ্ধ হয়েছিল। থিবাউ মিনের নির্বাসনের স্থান নির্বাচনের ব্যাপারে ভারত ও বার্মার মধ্যে অসংখ্য চিঠি ও টেলিগ্রাম চালাচালি হয়েছিল। লর্ড ডাফরিন ভারতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ শহরে থিবাউকে নির্বাসনের পক্ষপাতী ছিলেন না। তাই প্রাথমিকভাবে মাদ্রাজসহ বিভিন্ন শহরের নাম প্রস্তাবিত হলেও সেগুলো প্রত্যাখ্যাত হয়। অবশেষে রাজা থিবাউকে রত্নগিরিতে নির্বাসনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

রত্নগিরি। ভারতের পশ্চিমে আরব সাগরের তীরে অবস্থিত একটি পরিত্যক্ত বন্দর। আধুনিক সুযোগ-সুবিধার লেশমাত্র ছিল না তখন। কোনো রেল যোগাযোগও ছিল না। সেখানে সপরিবার জীবনের ৩০টি বসন্ত অতিবাহিত করেছিলেন থিবাউ মিন। বার্মার কোনবং সাম্রাজ্যের শেষ রাজা। দেশটির ইতিহাসের সর্বশেষ রাজাও বটে। রত্নগিরিতে তিনি অবকাশ যাপন করতে যাননি। হাওয়া বদলও উদ্দেশ্য ছিল না। সেখানে সপরিবার তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল।

রাজপরিবারের বসবাসের জন্য রত্নগিরির সবচেয়ে সুন্দর বাংলো দুটি ভাড়া নেয়া হয়েছিল। আউটর‍্যাম হল ও বেকার’স বাংলো। আউটর‍্যাম হলে কর্মচারীরা থাকতেন। রাজপরিবার ও পুলিশ কর্মকর্তা ফ্যানশের জন্য বরাদ্দ ছিল বেকার’স বাংলো। রাজপরিবারের জন্য বেকার’স বাংলোকে সুসজ্জিত করা হয়েছিল। ড্রইং রুমের মেঝেতে বিছানো হয়েছিল পারস্য থেকে আনা দামি গালিচা। ড্রইং ‍রুমের বাম পাশের দুটি বেডরুমে রাজপরিবারের সদস্যরা থাকতেন। তার পেছনের একটি বেডরুমে থাকতেন ফ্যানশ। প্রতিটি কক্ষ চমৎকার সব আসবাবপত্রে পরিপূর্ণ ছিল। ড্রইং রুমের ডান পাশে ছিল ডাইনিং রুম ও থিবাউ মিনের পড়ার ঘর। সেখানে একটি ডেস্ক, কয়েকটি চেয়ার ও একটি বুকশেলফ ছিল। বাংলোর টানা বারান্দায় পাতা ছিল সারি সারি চেয়ার।

রাজপরিবারের সেবার জন্য ব্রিটিশ সরকার ২৫ জন পরিচারক ও ছয়জন পরিচারিকা নিয়োগ দিয়েছিল। বাংলোর সামনে দুটি ঘোড়ার গাড়ি সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকত। বাংলো দুটি ছিল পশ্চিমমুখী। পারস্পরিক দূরত্ব ছিল ৪০০ গজ। নারিকেল বাগানের আড়ালে ঢাকা। রাজপরিবারের প্রহরার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের থাকার জন্য তিনটি চৌকি স্থাপন করা হয়েছিল। তারা রাজা থিবাউর প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখতেন। পুলিশ প্রধান ছিলেন ফ্যানশ। রাজার সঙ্গে কেউ দেখা করার আগে তার অনুমতি নিতে হতো।

১৮৮৬ সালের ১৬ এপ্রিল রাজা থিবাউ মিন তার দুই স্ত্রী সুপায়ালাত ও সুপেয়াগেলিকে নিয়ে রত্নগিরি পৌঁছলেন। রত্নগিরিতে তখন প্রায় ১১ হাজার মানুষের বসতি। সরকারি কর্মকর্তাদের সংখ্যা সীমিত। সেখানে একটি রেভিনিউ সার্ভে অফিস, কাস্টম হাউজ, জেলখানা, পোস্ট অফিস, কয়েকটি স্কুল ও গির্জা ছিল। অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। ইউরোপীয় কর্মকর্তা ও মিশনারিদের জন্য একটি ক্লাব ছিল। সেখানে লাইব্রেরি, রিডিং রুম, র‍্যাকেট কোর্ট, সুইমিং পুল, বাগানসহ বিনোদনের নানা ব্যবস্থা ছিল।

প্রথম দিন থেকেই রত্নগিরিকে রাজা থিবাউ মিন ও তার দুই রানী পছন্দ করতে পারেননি। পুলিশ কর্মকর্তা ফ্যানশের অনুমতি নিয়ে ভাইসরয়ের কাছে এ মর্মে একটি স্মারকলিপি পাঠিয়েছিলেন থিবাউ। তিনি রত্নগিরিকে বার্মার কাচিন ও কারেনের মতো দুর্গম গ্রামের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তার মতে, রত্নগিরি বসবাসের জন্য একেবারেই উপযুক্ত ছিল না। সেখানে প্রচুর সাপ ও বিছার বিচরণ বলে ভাইসরয়কে অবহিত করেন থিবাউ মিন। রত্নগিরির ভারী বর্ষণও তার কাছে অসহ্য ঠেকছিল।

তাকে সপরিবার বার্মায় ফেরত পাঠানোর জন্য ভাইসরয়ের কাছে অনুরোধ জানান। সেজন্য ব্রিটিশ সরকারের যেকোনো শর্ত মেনে নিতেও তিনি রাজি ছিলেন। কিন্তু তার এ আবেদন নাকচ হয়ে যায়। তখন তিনি ভারতবর্ষের অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ শহরে যাওয়ার আবেদন করেন। ব্রিটিশ সরকার তাও কবুল করল না।

ব্রিটিশ সরকার রাজা থিবাউ মিনকে নির্বাসন দিয়েছিল। মানুষের মন থেকে তার স্মৃতি মুছে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা রাজপরিবারের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছিল। সপ্তাহে দুবার ফলমূল ও বরফ আসত মুম্বাই থেকে। বাংলোর সামনে একটি আইস মেশিন স্থাপন করা হয়েছিল। বিস্কুট ও শুকনো ফলের টিন থাকত পর্যাপ্ত। দুধ সরবরাহের জন্য একটি গরুর খামার ছিল। রাজপরিবারের পছন্দের শূকরের মাংসের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য ছিল দুটি খোঁয়াড়। গ্রীষ্মকালে পাখা টানার জন্য দিনরাত পরিচারক ও পরিচারিকা নিয়োজিত থাকত। রাজপরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতের ভার ছিল সিভিল সার্জনের ওপর। রাজা থিবাউকে ইংরেজি শেখানোর জন্য একজন শিক্ষকও নিয়োগ দিয়েছিল সরকার।

নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা থাকলেও রাজা থিবাউ মিনের জন্য বরাদ্দ ভাতার পরিমাণ ছিল সীমিত। ছোট বাংলোতে থাকতেও বেশ কষ্ট হচ্ছিল। ১৯০৫ সালের ডিসেম্বরে মুম্বাইয়ের তৎকালীন গভর্নর লর্ড ল্যামিংটনের কাছে চিঠি লেখেন থিবাউ মিন। তিনি শহর থেকে কিছু দূরে একটি বাড়ি নির্মাণের অনুরোধ জানান। একই চিঠিতে আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বার্ষিক ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাবও রাখেন।

প্রস্তাবকে জোরদার করতে তৎকালীন কালেক্টর, অফিসার ইনচার্জ ও সিভিল সার্জনের রেফারেন্সও দেন থিবাউ মিন। প্রস্তাব আমলে নিয়ে ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ সরকার তার জন্য একটি প্রাসাদ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। তদনুসারে ২৭ একর জায়গায় ১ লাখ ২৫ হাজার রুপি ব্যয়ে নির্মিত হয় রাজকীয় বাসভবন। ল্যাটেরাইট ও লাভা রক দিয়ে তৈরি দ্বিতল প্রাসাদ।

এর ছাদ ছিল টালির তৈরি। মার্বেল পাথর ও টাইলস দিয়ে মেঝে সুসজ্জিত করা হয়েছিল।  লোকমুখে ‘থিবাউর প্রাসাদ’ নামে তা পরিচিতি পায়। এ প্রাসাদে একটি বড় দরবার হল ছিল। মূল দালানে ১৬টি প্রশস্ত কক্ষ ছিল। সেগুলোর সম্মিলিত আয়তন ছিল ২৫ হাজার বর্গফুট। কক্ষগুলোর মেঝে সুদৃশ্য গালিচায় মোড়ানো ছিল। পরিচারকদের জন্য ছিল ৬০টি কক্ষ। আস্তাবলে ছয়টি ঘোড়া ছিল। গ্যারেজে তিনটি ঘোড়ার গাড়ি ও একটি মোটর কার ছিল। দুটি রান্নাঘর ও দুটি ভাঁড়ার একটি গলিপথের মাধ্যমে মূল ভবনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। সুপেয় পানির জন্য দুটি কূপ খনন করা হয়েছিল। প্রাসাদটি পশ্চিমমুখী ছিল।

প্রাসাদ থেকে আরব সাগরের দৃশ্য উপভোগ করা যেত। রাজা থিবাউর জন্য বার্ষিক ভাতাও বরাদ্দ রেখেছিল ব্রিটিশ সরকার। প্রাথমিকভাবে এ ভাতা বার্ষিক ৩৫-৪২ হাজার রুপির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯০৬ সালে বার্ষিক ভাতার পরিমাণ বাড়িয়ে ১ লাখ রুপি করা হয়। এর মধ্যে মাসিক ৫ হাজার রুপি হিসেবে বার্ষিক পেনশন ৬০ হাজার রুপি, পোশাক ভাতা মাসিক ১২৫ রুপি হিসেবে বার্ষিক ৬ হাজার রুপি, উৎসব ভাতা বার্ষিক ১৫ হাজার ৫০০ রুপি, রিজার্ভ ফান্ডে সংরক্ষণের জন্য বার্ষিক ১৮ হাজার ৫০০ রুপি বরাদ্দ ছিল।  রত্নগিরিতে তিনি নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতেন। স্থানীয়দের সঙ্গে তার মেলামেশা ছিল না।

এমনকি তিনি প্রাসাদ থেকে বেরও হতেন না। তবে দাতা হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। আঞ্চলিক বিভিন্ন উৎসবে তিনি পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। বিশেষ করে দীপাবলি উৎসবে তিনি বেশ খরচ করতেন। থিবাউ মিনের প্রত্যক্ষ‌ নির্দেশনায় প্রাসাদ চত্বরে আয়োজিত আতশবাজির প্রদর্শনী ছিল স্থানীয়দের জন্য বিশেষ আকর্ষণ। সাধারণত প্রাসাদের দরবার হলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতো। তবে বড় ও জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রাসাদ চত্বরে প্যান্ডেল খাটানো হতো। সেখানে অতিথিদের আপ্যায়নের নানা বন্দোবস্ত থাকত। অতিথিদের রেশমের ধুতি উপহার দিতেন রাজা থিবাউ মিন। এসব কাপড় মুম্বাই থেকে কেনা হতো কিংবা বার্মা থেকে আমদানি করা হতো। বরাদ্দ ভাতা থেকে এতকিছু করা সম্ভব ছিল না। তাই থিবাউকে প্রায়ই তার ধনরত্ন বিক্রি করতে হতো। ধারদেনাও করতেন প্রচুর।

মুদি দোকানদারসহ পরিচিত সবার কাছ থেকেই তিনি ধার করতেন। তার অমিতব্যয়িতার বয়ান দিতে গিয়ে রত্নগিরির এক কালেক্টর লিখেছেন, ‘তিনি বেশ দয়ালু ছিলেন। পাপমুক্ত ছিলেন। সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন। অল্পতেই তুষ্ট ছিলেন। সুখী ছিলেন। তবে তার একটি দোষ ছিল। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় তিনি একেবারেই অদক্ষ ছিলেন। তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে জলের মতো অর্থ গড়িয়ে পড়ত। তার ব্যয় সীমিত করা অসম্ভব ছিল। অর্থ ব্যয় করা ছিল তার অন্যতম শখ।’

১৯১০ সালে রত্নগিরির কালেক্টরের দেয়া এক হিসাব অনুযায়ী, সে সময় থিবাউ মিনের ঋণের পরিমাণ ছির ৬০ হাজার ৭০০ রুপি। তার মাসিক সুদের পরিমাণই ছিল ৩ হাজার ২৬০ রুপি। অথচ সে সময় তার মাসিক পেনশনের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৫০০ টাকা। ‘এক্স কিং থিবাউস অ্যাক্ট, ১৮৯৫’ অনুসারে এ বিপুল পরিমাণ দেনা থেকে তিনি নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন। এ আইন অনুসারে থিবাউ মিনের ঋণ নেয়ার অনুমোদন ছিল না।

তাই তিনি ঋণ পরিশোধেও বাধ্য নন। রত্নগিরির কালেক্টরের নির্দেশে থিবাউ মিনকে ঋণ দেয়া মহাজনদের প্রাসাদে প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। থিবাউর প্রাসাদে পরিচারক ও অধীনদের জন্য অনেক কোয়ার্টার ছিল। তারা সবাই ছিলেন মারাঠি। রত্নগিরিতে প্রথম মোটর গাড়ির মালিক ছিলেন থিবাউ মিন। কিন্তু তাতে কখনো চড়েননি তিনি। মুম্বাইয়ের গভর্নর একবার রত্নগিরি পরিদর্শনে আসার পর গাড়িটি ব্যবহার করতে চাইলে থিবাউ মিন অনুমতি দেননি। এটি ছিল দুই সিলিন্ডারের একটি গাড়ি। মডেল ১০/১২ এইচপি ডে ডিয়ন কার। গাড়িটি নিয়ে মজার তথ্য দিয়েছেন সুধা শাহ। পারুলকর নামে রত্নগিরির এক অধিবাসীর বরাতে তিনি লেখেন, ‘রত্নগিরি জেলায় রাজা থিবাউর মোটর গাড়িটিই ছিল প্রথম। সাধারণ মানুষ আভূমি নত হয়ে এটিকে প্রণাম করত।

এর সামনে ঘাস রাখত। কারণ তারা ভাবত যে গাড়িটির খেতে হয়! তারা মনে করত যে এটি গরু কিংবা ঘোড়ায় টানা নতুন কোনো গাড়ি!’ মোটর গাড়ি কেনার জন্য ব্রিটিশ সরকার থিবাউ মিনকে রিজার্ভ ফান্ড থেকে ১০ হাজার রুপি বরাদ্দ দিয়েছিল। ১৯০৯ সালে রাজা থিবাউ মিন রিজার্ভ ফান্ড থেকে ৫ হাজার রুপির জন্য আবেদন করেন। এ অর্থ দিয়ে তিনি প্রাসাদ চত্বরে রানীদ্বয় ও রাজকুমারীদের জন্য একটি ‘সামার হাউজ’ নির্মাণ করেন। রত্নগিরিতে থিবাউ মিনের অবস্থানের বিশদ বিবরণ ‘বার্মা কিংস ফাইল’ নামে দুটি বড় ভলিউমে লিপিবদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৯৩৫ সালের দিকে ভলিউম দুটি নষ্ট হয়ে যায়।

রত্নগিরির নির্বাসিত জীবনে রাজা থিবাউ মিন ধর্মকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। দিনে দুইবার (সকাল ও সন্ধ্যায়) তিনি ‘ত্রিরত্ন’ তথা বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্ঘের প্রার্থনা করতেন। ‘দ্য কিং ইন এক্সাইল’ নামে থিবাউ মিনের জীবনী রচনা করেছেন সুধা শাহ। বইটিতে রাজা থিবাউ মিনের এক নাতির বরাতে চমৎকার একটি কথোপকথন উল্লেখ করেছেন তিনি। কথোপকথনটি রাজা থিবাউ ও রানী সুপায়ালাতের মধ্যে হয়েছিল। একদিন থিবাউ প্রার্থনা সমাপ্ত করলে সুপায়ালাত তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘প্রার্থনার পর তুমি কী কামনা করো?’ থিবাউ উত্তর দিলেন, ‘আমি সবার শান্তি ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি।’ সুপায়ালাত বললেন, ‘সবার মধ্যে তুমি ব্রিটিশদের অন্তর্ভুক্ত করো না।

’ থিবাউ বললেন, ‘এভাবে বলে না প্রিয়, ব্রিটিশরাও তো মানুষ!’ সুপায়ালাত ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘মানুষ! তারা আমাদের শত্রু। দেখো, তারা আমাদের কী অবস্থা করেছে। ব্রিটিশদের কারণেই আমরা কষ্ট পাচ্ছি। তাই তুমি তাদের কোনো আশীর্বাদ করবে না!’ এ কথোপকথন থেকে ব্রিটিশদের প্রতি রানী সুপায়ালাতের মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। এটাও বোঝা যায় যে ক্ষমতাচ্যুত নির্বাসিত জীবনে রাজা থিবাউ মিনের মানসিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল। ব্রিটিশদের প্রতি তার কোনো বিদ্বেষ ছিল না।

তার তখনকার জীবন থেকে আন্দাজ করার কোনো উপায় নেই ক্ষমতায় থাকাকালে রানী সুপায়ালাতের পরামর্শে তিনি ৮০ জন জ্ঞাতিকে হত্যা করেছিলেন! কোনবং সাম্রাজ্যের সম্ভাব্য সব উত্তরাধিকারীকে নিশ্চিহ্ন করাই ছিল এ হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য। রাজা থিবাউ মিনের মানসিকতার এ পরিবর্তনের কারণে সুপায়ালাত তার প্রতি বিরক্ত ছিলেন। তার মতে, থিবাউ মিন নরম প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি অত্যধিক ধার্মিক ছিলেন। তার মতো মানুষের রাজা হওয়া উচিত নয়। বৌদ্ধ ভিক্ষু হলেই বরং তিনি ভালো করতেন। রানী সুপায়ালাত আমৃত্যু ব্রিটিশদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করেছিলেন। তার সন্দেহ ছিল যে ব্রিটিশরা খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে রাজপরিবারের সদস্যদের হত্যা করবে।

রত্নগিরিতে রাজা থিবাউ মিনের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের একটি বিবরণ পাওয়া যায় তার এক সচিবের বরাতে। বিবরণী অনুসারে, তিনি সকাল ৮টায় ঘুম থেকে উঠতেন। ৯টায় সকালের নাশতা সারতেন। দুপুরের খাবার খেতেন ১২টায়। বিকাল ৫টায় তিনি চা খেতেন। রাত ৯টায় সারতেন ডিনার। মাঝরাতে তিনি ঘুমাতে যেতেন। বিকালে দর্শনার্থীরা রাজা থিবাউ মিনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেতেন। জুতা নিয়েই তারা প্রাসাদে প্রবেশের অনুমতি পেতেন। চেয়ারেও বসতে পারতেন। তবে রাজা থিবাউ মিন তাদের তুলনায় উঁচু আসনে বসতেন।

রানী সুপায়ালাত নিয়মিত রান্না করতেন। প্রতিদিন প্রার্থনা করতেন। টেবিল ক্লথ ও মাদুর বুনতেন। বার্মার খবর জানার জন্য ‘হানথাওয়াডি ডেইলি’ ও ‘মিয়ানমার অ্যালিন’ নামে দুটি সংবাদপত্র পড়তেন। তার এক নাতনির বরাতে সুধা শাহ লেখেন, ‘প্রায় সময় তিনি সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তিনি তার ঘরের কথা ভাবতেন। তার হৃত ক্ষমতার কথা ভাবতেন। মান্দালয়ের রাজপ্রাসাদে তার কর্তৃত্বের কথা ভাবতেন। তার বন্দিদশা নিয়ে তিনি সব সময় বিমর্ষ থাকতেন।’ পর্যায়ক্রমে তার স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটে। মানসিকভাবেও খানিকটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যান।

১৯১২ সালের ২৮ জুন থিবাউ মিনের ছোট রানী সুপেয়াগেলি মারা যান। ১২ বছর ধরে তিনি গ্যাস্ট্রিকে ভুগেছিলেন। থিবাউ তার দেহাবশেষ মান্দালয়ে পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বার্মার তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর অনুমতি দেননি। বাধ্য হয়ে প্রাসাদ চত্বরেই তাকে সমাহিত করা হয়।

শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে ব্রিটিশরা রেঙ্গুনে নির্বাসন দিয়েছিল। আর রাজা ‍থিবাউ মিনের কপালে জুটেছিল রত্নগিরি। মাতৃভূমি থেকে তাকে যথাসম্ভব দূরে নির্বাসন দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল ব্রিটিশরাজ। বাহাদুর শাহ জাফরের মতো তিনিও স্বভূমে ফেরার আকুতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু মঞ্জুর হয়নি। তার সমাধিও রচিত হলো বিভুঁইয়ে।

১৯১৬ সালের জুলাইয়ে থিবাউ মিন বেশ অসুস্থ হয়ে যান। ১৫ ডিসেম্বর অবস্থার বেশ অবনতি ঘটে। জরুরি ভিত্তিতে সিভিল সার্জনকে ডেকে পাঠানো হয়। ১৬ ডিসেম্বর মারা যান বার্মার শেষ রাজা থিবাউ মিন। ১৯১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তার শ্রাদ্ধের আয়োজন করা হয়। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৫ হাজার রুপি বরাদ্দ দিয়েছিল। ১৯১৯ সালের ১৯ মার্চ রত্নগিরিতে তার সমাধি নির্মাণ করা হয়। আজও তা বার্মার শেষ রাজা থিবাউ মিনের স্মৃতি বহন করছে।

তথ্যসূত্র: সুধা শাহ, দ্য কিং ইন এক্সাইল

১. The King in the Exile: The Fall of the Royal Family of Burma, Sudha Shah

২. Fielding, Thibaw’s Queen, pp. 19, 65–66.

৩. Princess Hteik Su Gyi Phaya’s (Rita) letter to Mr Symington dated 22 December 1970, British Library, London, MSS Eur D 1156/7.

75 ভিউ

Posted ১২:০৬ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

coxbangla.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

Editor & Publisher

Chanchal Dash Gupta

Member : coxsbazar press club & coxsbazar journalist union (cbuj)
cell: 01558-310550 or 01736-202922
mail: chanchalcox@gmail.com
Office : coxsbazar press club building(1st floor),shaheed sharanee road,cox’sbazar municipalty
coxsbazar-4700
Bangladesh
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
বাংলাদেশের সকল পত্রিকা সাইট
Bangla Newspaper

ABOUT US :

coxbangla.com is a dedicated 24x7 news website which is published 2010 in coxbazar city. coxbangla is the news plus right and true information. Be informed be truthful are the only right way. Because you have the right. So coxbangla always offiers the latest news coxbazar, national and international news on current offers, politics, economic, entertainment, sports, health, science, defence & technology, space, history, lifestyle, tourism, food etc in Bengali.

design and development by : webnewsdesign.com